পহেলা বসন্ত,
-তিষ্যানন্দ ভিক্ষু
শীতের জীর্ণতা সরিয়ে ফুলে ফুলে সেজেছে এখন প্রকৃতি। গাছে গাছে নতুন পাতা, স্নিগ্ধ সবুজ ছোট কচি পাতা। ধীর গতিতে বাতাসের বয়ে চলা জানান দিচ্ছে নতুন কিছুর।
পলাশ রাঙ্গা সকালে দখিনা হাওয়ায় আমের মুকুলের দোলা জানান দিলো, এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত।
জীবনের এসেছে পূর্ণতা। নতুন প্রাণের কলরব। চারুকলার বকুলতলায়, তাই বসন্ত বরণের উৎসবে টানে, দালানের খোলস ছেড়ে বাসন্তী সাজে জড়ো হবে নগরবাসী। সুরের সম্মোহনে বকুলতলায় ফাল্গুনের প্রথম প্রহরে মিলে মিশে একাকার প্রকৃতি আর মানুষ।
সকল কুসংস্কারকে পেছনে ফেলে, বিভেদ ভুলে, নতুন কিছুর প্রত্যয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা নিয়ে বসন্তের উপস্থিতি। তাই কবির ভাষায়-
‘ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত’।
এখন আগের মতো ফুল ফুটে না,বাংলার প্রকৃতি পরিবর্তনের পথে,তার জন্য আমরাই দায়ী।
বাংলার বন এখন উজাড় হলেও এই কংক্রিটের নগরীতে কোকিলের কুহু ধ্বনিত হয় ফাল্গুনের আগমন সামনে রেখে। ফুলের মঞ্জরিতে মালা গাঁথার দিন বসন্ত কেবল প্রকৃতিকেই রঙিন করেনি, রঙিন করেছে আবহমানকাল ধরে বাঙালি তরুণ-তরুণীর প্রাণও।
বাংলার বিখ্যাত কবি রবীন্দ্রনাথ,কাজী নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু গুণ বসন্ত নিয়ে লিখে গেছেন শত গান ও কবিতা।
জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় কাত হয়ে বসন্ত চিৎপটাং আজ। বসন্তের ফুল শিমুলের বুক ফেটে বেরিয়ে আসা তুলা পেঁজা মেঘের মতো উবে গেছে, খুব কমে গেছে শিমুল তুলার গাছ। কেননা আমরা সভ্য হয়েছি। আমাদের নানান কাজে শিমুল গাছটা খুব লাগে। যেহেতু আমাদের কাজের গুরুত্ব আগে, তাই শিমুলকে মরতে হয়।
বাংলার বসন্ত কখনো উৎসবের, কখনো বিচ্ছেদের, কখনো বিষাদের, আবার কখনোবা সংগ্রামের। বসন্তকে এড়ানোর সাধ্য নেই কারো।
ফাল্গুনের আরেক পরিচয় ভাষা শহীদদের তপ্তশোতিক্ত মাস।বসন্ত যেন বারবার বাঙালির জীবনে ফিরে আসে হারানো অধিকার ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ের অনুষঙ্গ হয়ে। নয় ফাগুন বাংলার ছাত্র যুবকরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে অকাতরে বিলিয়েছে আপন প্রাণ। বসন্তের প্রথম দিনেই মজিদ খানের কুখ্যাত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়েছিল। পলাশরাঙা বসন্তের প্রথম দিনেই জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, দীপালিদের রক্ত মিশেছে রাজপথে।
ঊনিশ’ বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ আটই ফাল্গুন মাতৃভাষা ‘বাংলা’ প্রতিষ্ঠার জন্য রফিক, সালাম, জব্বার প্রমুখ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন।
বিশ’ পঁচিশ এর ফাগুনে বাংলার রাজপথ মুমূর্ষু প্রায়।
তবুও
বারবার ফিরে আসে ফাল্গুন, আসে বসন্ত। নৈসর্গিক ক্যানভাসে রক্তাক্ত বর্ণমালা যেন এঁকে দেয় অনির্বচনীয় সুন্দর এক আল্পনা। প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে উদার সড়কের বুকে। দেয়ালগাত্র থেকে বইমেলা, লোহিত ধারার মোহনা শহীদ মিনার পর্যন্ত।
বাস্তব বড় নির্মম। বসন্ত ঋতুর স্বভাব হয়ে যাচ্ছে অন্য রকম। প্রাণ উতলা করা কোকিলের কুহু তান, বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ বয়ে নিয়ে আসা বসন্ত বাতাস যদি পাল্টে যায়, কি লাভ হবে বসন্তে..?
ফিরিয়ে আনতে হবে প্রকৃতির স্বাভাবিকতাকে, তবেই থামবে পাল্টাপাল্টির খেলা। ফিরে পাব আবার সেই বসন্ত দিন, যখন বসন্ত বাতাসে বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ দিব্যি ভেসে আসবে। তখনই জমবে ভালোবাসাবাসির সত্যি খেলা।
প্রেমময় মন গেয়ে উঠবে-‘আহা আজি এ বসন্তে’
মন্তব্য করুন