অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত, নিঃশব্দ চারদিক। দূরে সমুদ্রের গর্জন আর কাছে টহল দেওয়া পুলিশের গাড়ির লাল-নীল আলো। কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে সে রাত ছিল যেন মৃত্যুর মঞ্চ -শান্ত, ধোঁয়াটে, কিন্তু অদ্ভুত রকম অশুভ।
মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান, সেনাবাহিনীর এক দুর্দান্ত কর্মকর্তা, যিনি জাতিসংঘ মিশনে কাজ করেছেন, নিজের দেশের পতাকার গৌরবকে বহন করেছেন বহু ভূমিতে, সেই মানুষটি এখন ক্যামেরা হাতে এক নতুন যুদ্ধের পথে। যুদ্ধটা আর রাইফেল দিয়ে নয় -তথ্য দিয়ে, সত্য দিয়ে। প্রকৃতির সৌন্দর্য, পাহাড়-সমুদ্রের অজানা গল্প আর অন্ধকারে ঢাকা প্রশাসনের বাস্তবতা—সব কিছু তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তিনি তাঁর ডকুমেন্টারি প্রজেক্টে।
৩১ জুলাই, ২০২০। নিঃশব্দ রাতে কক্সবাজারের টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ রোডে হঠাৎ করেই ভেসে আসে গুলির শব্দ। মুহূর্তেই থেমে যায় এক সাহসী যোদ্ধার নিঃশ্বাস। তিনি মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ। সিনহা সেই রাতে সহকর্মী সহ ফিরছিলেন টেকনাফ থেকে। মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া পুলিশ চেকপোস্টে পৌঁছানোর পর তাদের গাড়ি থামে । কিছু প্রশ্ন, কিছু সন্দেহ, আর তারপর — গুলির শব্দ।
একবার নয়, একাধিকবার গুলি ছোড়া হয়। মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সিনহা। রক্তে ভেসে যায় রাতের আঁধার। সিনহা মারা যান ঘটনাস্থলেই।
পুলিশ জানায়, “বন্দুকযুদ্ধে” সিনহা নিহত হয়েছেন। বলা হয়, তিনি অস্ত্র তাক করেছিলেন পুলিশের দিকে।
কিন্তু প্রশ্ন ওঠে—একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা, যিনি নিজেই ভিডিও ডকুমেন্টারি বানাচ্ছিলেন, যাঁর কাছে ছিল অস্ত্রের লাইসেন্স, তিনি কেন পুলিশের দিকে অস্ত্র তাকাবেন? সামাজিক মাধ্যমে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে খবর। সেনাবাহিনীর সাবেক-বর্তমান সদস্যরা আর চুপ করে থাকে না, জনগণও নয়। একজন দেশপ্রেমিক যোদ্ধার মৃত্যু নিয়ে মুখ বন্ধ রাখা যায় না।
কিন্তু প্রশ্ন হলো — কেন তাকে মরতে হলো? অপরাধ কী ছিল তার? কেবল সন্দেহ? নাকি কেউ চেয়েছিল তার পথ চিরতরে থামিয়ে দিতে? সেই রাতে সিনহা কোনো অপরাধ করেননি। তার হাতে ছিল ক্যামেরা, অস্ত্র নয়। কিন্তু তাকেই প্রতিপক্ষ বানিয়ে গুলি চালানো হলো — নির্মমভাবে, নৃশংসভাবে।
পরে জানা যায়—
•পুলিশের দায়িত্বরত কর্মকর্তা পরিদর্শক লিয়াকত আলী বিনা উস্কানিতে গুলি চালান।
•গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাস্তায় পড়ে ছিলেন মেজর সিনহা। তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে পরবর্তীতে ওসি প্রদীপ কুমারও ২টি গুলি করেন। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর একটি ট্রাকে করে তাকে হাসপাতাল নেয়া হয়। কিন্তু তার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
•ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, যিনি নানা অভিযোগে অভিযুক্ত, ছিলেন ঘটনার মূল মদদদাতা।
•সিনহাকে হত্যার পেছনে ছিল ক্ষমতার অপব্যবহার, মাদক-সন্ত্রাস দমনের ছদ্মাবরণে গড়ে ওঠা এক মাফিয়া জগৎ।
বিচার প্রক্রিয়া ও ২০২২ সালের জানুয়ারিতে রায় ঘোষণা:
•হত্যাকাণ্ডের পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এরপর ২০২০ সালের ৫ আগস্ট মেজর সিনহার বোন টেকনাফ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ এবং উপ-পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ৯ জনকেই দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়। এই মামলায় বর্তমানে ৭ জন আসামী কারাগারে রয়েছেন।
•একই বছরের ২৭ আগস্ট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন এপিবিএনের তিন সদস্য এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আব্দুল্লাহ। একই মামলায় টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ ও এসআই নন্দদুলাল রক্ষিতকে তদন্তকারী সংস্থা হিসেবে র্যাব জিজ্ঞাসাবাদ করে। ৩০ আগস্ট মামলার প্রধান আসামি টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক ইনচার্জ লিয়াকত আলী সাবেক মেজর সিনহা হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন।
•২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি আদালত ১৫ জন অভিযুক্তের রায় ঘোষণা করে। রায়ে প্রদীপ এবং লিয়াকতকে মৃত্যুদণ্ড, ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সাতজনকে খালাস প্রদান করে। এছাড়াও যাবজ্জীবন ছয়জন প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়।
তবে প্রশ্ন থেকে যায় –?
এই ঘটনায় যারা অপরাধী ছিল, তারা কি একদিনেই অপরাধী হয়েছিল?
না কি, দীর্ঘদিন ধরে পোষা দানবেরা একদিন রক্ত পিপাসু হয়ে উঠেছিল?
সিনহা আজ নেই, কিন্তু তার প্রশ্নগুলো রয়ে গেছে। রয়ে গেছে তার ক্যামেরায় ধরা স্বপ্নগুলো, রয়ে গেছে তার সেই সাহসী চোখদুটো- যা চেয়েছিল দেশের ভিতরকার অন্ধকারকে আলোকিত করতে। সিনহা শুধু একজন ব্যক্তি ছিলেন না – তিনি ছিলেন একটি আদর্শ, একটি প্রতিবাদ, একটি প্রেরণা।
তবে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর অমিমাংশিত রয়ে যাবে যুগ যুগ ধরে?
•দেশের একজন সৎ, দেশপ্রেমিক অফিসারের জীবনের মূল্য কতটুকু?
•যারা আইন রক্ষা করার শপথ নিয়েছিল, তারাই যদি অস্ত্র তুলে নেয় নিরপরাধ মানুষের উপর- তাহলে নিরাপত্তা কোথায়?
এখনো আমাদের জানা নেই কত প্রদীপ, কত লিয়াকত এখনো পুলিশ বাহিনীতে ঘাপটি মেরে আছে। কে জানে? যে কোনো সময় যে কেউ প্রদীপ রূপে ফিরে আসবে। আরো বড় প্রশ্ন হলো, সিনহা একজন সেনা কর্মকর্তা বলে এই ঘটনাটি খুবই গুরুত্ব পেয়েছিলো। যদি সেটা আমাদের মত সাধারণ কেউ হতো, তাহলে কি হতো-?
মন্তব্য করুন